চয়ন চৌধুরী/ টাঙ্গুয়ার হাওর থেকে ফিরে/সুনামগঞ্জ জেলার মধ্যনগর ও তাহিরপুর উপজেলার ১০টি মৌজা জুড়ে বিস্তৃত টাঙ্গুয়ার হাওর। প্রায় ৯ হাজার ৭০০ একর আয়তনের বিস্তৃত এই হাওর বাংলাদেশের এক অনন্য প্রাকৃতিক সম্পদ।২০০০ সালে জাতিসংঘের রামসার কনভেনশনের অধীনে এটি আন্তর্জাতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ জলাভূমি হিসেবে স্বীকৃতি পায়।স্থানীয়ভাবে ‘মাছের ভাণ্ডার’ খ্যাত এ হাওরে প্রায় ১৪০ প্রজাতির মাছ পাওয়া যায়। জেলা মৎস্য অফিসের তথ্য মতে, প্রতিবছর এখান থেকে প্রায় ৩০০ মেট্রিক টন মিঠা পানির মাছ আহরিত হয়। তবে অবৈধ জাল ব্যবহার, প্রজনন মৌসুমে নির্বিচারে মাছ শিকার এবং জলজ উদ্ভিদ ধ্বংসের কারণে হাওরের দেশীয় প্রজাতিগুলো বিলুপ্তির পথে। পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) জরিপে দেখা গেছে, হাওরের প্রায় ৬০ ভাগ দেশীয় মাছ বিলুপ্তির ঝুঁকিতে রয়েছে।শীতকালে এই হাওরে আশ্রয় নেয় হাজার-হাজার অতিথি পাখি। বাংলাদেশ বন বিভাগের তথ্যমতে, প্রতিবছর প্রায় দুই শতাধিক প্রজাতির পাখি এখানে অবস্থান করে। রাজহাঁস, গাংচিল, লালমাথা খঞ্চিলসহ নানা প্রজাতির পাখির সমারোহে শীতের হাওর এক ভিন্ন রূপ ধারণ করে।
সম্প্রতি হাইকোর্ট টাঙ্গুয়ার হাওরকে নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে মন্তব্য করেছে, সুরক্ষিত ব্যবস্থাপনার অভাবে আজ এ হাওর অভিভাবকহীন, সবাই মিলে যেমন ইচ্ছা তেমন ধ্বংস করছে। উচ্চ আদালতের নির্দেশ মতে, টাঙ্গুয়ার হাওরে সরকারি নির্দেশনা মেনে হাউসবোটগুলো চলে কি না, কতগুলো হাউসবোট আছে, মালিকদের নাম-ঠিকানা ও মুঠোফোন নম্বর, কোন ঘাটে অবস্থান করে, কোন রুটে চলাচল করে, এগুলো যথাযথভাবে নিবন্ধিত কি না এবং সরকারি কর প্রদান করা হয় কি না—এসব বিস্তারিত প্রতিবেদন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে দাখিল করতে হবে।
পরিবেশবিদরা মনে করছেন, আদালতের এ নির্দেশ বাস্তবায়িত হলে প্রথম দিকে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো কিছুটা চাপে পড়লেও দীর্ঘমেয়াদে টাঙ্গুয়ার হাওর এবং পর্যটন শিল্পের জন্য তা সুফল বয়ে আনার মতো পদক্ষেপ।
টাঙ্গুয়ার হাওর ঘিরে প্রায় ৫০ হাজার মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন। এখানকার অধিকাংশ লোকজনই মাছ ধরা, কৃষিকাজ ও নৌপরিবহনের সঙ্গে যুক্ত। কিন্তু লিজ প্রথা ও প্রভাবশালীদের নিয়ন্ত্রণে সাধারণ জেলেরা প্রায়ই বঞ্চিত হন। স্থানীয় জেলে আব্দুল হামিদ বলেন, আগে বর্ষায় নৌকা ভরে মাছ পেতাম। এখন খরচ উঠানোই সম্ভব হয়না।পর্যটনের দিক থেকেও টাঙ্গুয়ার হাওরের সম্ভাবনা বিপুল।বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) জানায়, প্রতিবছর প্রায় তিন থেকে পাঁচ লাখ পর্যটক টাঙ্গুয়ার হাওরে ভ্রমণে আসেন।স্থানীয় উদ্যোক্তারা বলছেন, সঠিকভাবে সরকারি সহযোগিতা পেলে এ হাওর থেকে বছরে শত কোটি টাকা রাজস্ব আয় সম্ভব। তবে অবকাঠামো, স্যানিটেশন, নিরাপত্তা ও নৌযান নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা না থাকায় পর্যটকদেরকে নানা ভোগান্তির শিকার হতে হয়।মধ্যনগর উপজেলার স্থানীয় একাধিক সাংবাদিক জানান, টাঙ্গুয়ার হাওরকে বাঁচাতে হলে এটিকে ইকো-ট্যুরিজম জোনে পরিণত করতে হবে। পাশাপাশি অবৈধ মাছ ধরা ও বনজ সম্পদ আহরণ কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা ছাড়া কোনো বিকল্প নাই।প্রকৃতির অপার লীলাভূমি টাঙ্গুয়ার হাওর শুধু সুনামগঞ্জ নয়, গোটা দেশের জন্য এক অমূল্য সম্পদ। আদালতের নির্দেশনা সঠিকভাবে কার্যকর হলে হাওর সংরক্ষণ যেমন সম্ভব হবে, তেমনি পর্যটন শিল্পও টেকসইভাবে এগিয়ে যাবে বলে সংশ্লিষ্টরা আশা করছে।