পরেশ দেবনাথ(নিজস্ব প্রতিনিধি)যশোরের কেশবপুর ও আশপাশ এলাকা থেকে অবাধে কৃষকের অগোচরে বন্ধুর ভূমিকা পালনকারী প্রাকৃতিক পানি শোধন ফিল্টার নামক প্রাণি শামুক নিধন করা হচ্ছে। এর ফলে মৎস্য ও কৃষি বিভাগও এখন হয়ে পড়েছে চিন্তিত। দাবি উঠেছে এখনি শামুক নিধনকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে এলাকা থেকে প্রাকৃতিক ভারসাম্য বিনষ্ট হয়ে পড়বে।ভবদহ অঞ্চলের কেশবপুর উপজেলায় ৫৫ হাজার ৮৬৭বিঘাতে ৪ হাজার ৬৫৮টি ঘের ও ৫ হাজার ৮৮৭ বিঘায় ৬ হাজার ৯৯৫টি পুকুর ও দিঘী রয়েছে। মনিরামপুর উপজেলায় রয়েছে ৬৮ হাজার ৬১০ বিঘায় ৪ হাজার ৮৮৯টি ঘের ও ৩৪ হাজার ২৩৭ বিঘায় আছে ১১ হাজার ৬৪৩টি পুকুর ও দিঘী এবং অভয়নগর উপজেলায় রয়েছে ৩৪ হাজার ৪২৫ বিঘা জমিতে ১ হাজার ২০৫টি ঘের ও ২৫ হাজার ৮৯০ বিঘায় ৪ হাজার ৮১০টি পুকুর ও দিঘী। এ ছাড়াও তিনটি উপজেলায় রয়েছে অসংখ্য উন্মুক্ত জলাবদ্ধ বিল যা ঘের হিসেবে ব্যবহার করা হয় না। এলাকার দরিদ্র নারী পুরুষ ও শিশুরা এ সব ঘের, পুকুর, দিঘী ও উন্মুক্ত জলাবদ্ধ বিল থেকে শামুক সংগ্রহ করে পাইকারি ব্যবসায়ীদের কাছে ৭থেকে ৮ টাকা কেজি দরে বিক্রি করে থাকে। ভোর থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত বিভিন্ন সড়কের পয়েন্টে পয়েন্টে পাইকাররা ভ্যান, সাইকেল, দাঁড়িপাল্লা নিয়ে বসে থাকে। সকাল থেকেই ওই সব পয়েন্টে গিয়ে নারী-পুরুষ ও শিশুরা শামুক-ঝিনুক বিক্রি করে থাকে।এ সব পাইকারি ব্যবসায়ীরা শামুক-ঝিনুক থেকে মাংস বের করে ঘের মালিকদের কাছে ৫০ থেকে ৬০ টাকা কেজিতে বিক্রি করেন। আবার শামুক ঝিনুকের খোলা বস্তা প্রতি ১২০ টাকা থেকে ১৫০ টাকায় বিক্রি করছে চুন তৈরির কারখানায়। মূলত ঘের ও চুন কারখানার মালিকরাই অস্বচ্ছল পরিবারের নারী-পুরুষ ও শিশুদের উদ্বুদ্ধ করে শামুক-ঝিনুক ধরতে। চুন কারখানার মালিকরা পাইকারদের কাছে অগ্রিম টাকা দিয়ে রাখে শামুক-ঝিনুক কেনার জন্য। মনিরামপুরের গোপালপুরে ২টি ও চেচুড়িয়ায় ১টি মোট ৩টি বড় ধরণের চুন তৈরির কারখানা রয়েছে।উপজেলার আড়য়া গ্রামের ফতেমা বেগম জানান, তার পরিবারের ৩-৪ জন বিল খুকখিয়াসহ অন্যান্য জলাবদ্ধ বিল পুকুর ও দিঘী থেকে শামুক-ঝিনুক এনে ৭ থেকে ৮ টাকা কেজিতে পাইকারদের কাছে বিক্রি করে থাকি। প্রতিদিন এক থেকে দেড় মন শামুক-ঝিনুক তারা সংগ্রহ করে। সাগরদত্তকাটি গ্রামের শামুক ব্যবসায়ী জয়দেব বলেন, জলাবদ্ধ বিল এলাকা থেকে শামুক কিনে কপালিয়া এলাকার মাছের ঘের মালিকদের নিকট বিক্রি করে থাকি। এতে তাদের প্রতি কেজিতে ২০ টাকা থেকে ৩৫ টাকা পর্যন্ত লাভ থাকে।চুন তৈরির কারখানার মালিক সমিরন দাস জানান, তার কারখানায় যে চুন তৈরি হয় তার তিন ভাগের দুই ভাগ চুন ঘের মালিকদের কাছে ৫০ কেজি বস্তা প্রতি ১ হাজার ৯০০ শত টাকায় বিক্রি করে থাকে। আর এক ভাগ চুন পান ও অন্যান্য কাজে ব্যবহারে বিক্রি করে দেয়। সে আরো জানান, শামুক-ঝিনুক কেনার জন্য পাইকারদের কাছে অগ্রিম টাকা দিয়েও রাখেন। ঘের মালিক আকবর হোসেন ও মোস্তাক হোসেন জানান, ঘেরের মাছ মোটাতাজা করা ও খাদ্য হিসেবে তারা শামুক-ঝিনুকের মাংস কিনে ঘেরে দেয়। এলাকা থেকে অবাদে শামুক নিধন হওয়ায় সচেতন মহল মৎস্য ও কৃষি অধিদপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নিকট শামুক নিধনকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি করেছেন।উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, শামুক মারা গেলে মাংস পঁচে ও খোলায় ক্যালসিয়াম, ফসফরাস ও পটাশ জাতীয় বস্তু মাটিতে তৈরি হয়। এর ফলে যে ক্ষেতে বেশি শামুক থাকে সেখানে ফসল ভাল উৎপাদন হয়। শামুকের কারণে ক্ষেতের উর্বরতা শক্তি বাড়ে।এ ব্যাপারে কেশবপুর উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা সুদীপ বিশ্বাস বলেন, শামুকের শরীরে রয়েছে প্রাকৃতিক জল শোধন ব্যবস্থা (ফিল্টার)। এরা ময়লা যুক্ত পানি পান করে ময়লা খাদ্য হিসেবে ভেতরে রেখে যে পানিটা বাইরে ছেড়ে দেয় সেটা বিশুদ্ধ। শামুকের বিশুদ্ধ পানির কারণে বিলে কই, শোল, শিং ও কার্প জাতীয় মাছ শামুক ও শামুকের ডিম খেয়ে বেঁচে থাকে। জলাবদ্ধ বিল থেকে শামুক কমে গেলে পানি নষ্ট হয়ে যায়। ফলে পানির রং পরিবর্তন হয়ে রোগ জীবাণু বেড়ে যায়।তিনি আরও বলেন, ২০১২ সালে ১০ জুলাই প্রকাশিত সরকারি প্রজ্ঞাপনে শামুককে বন্য প্রাণি হিসেবে গণ্য করা হয়। সে হিসেবে অবৈধ ভাবে শামুক ধরা ও বিক্রি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। বিষয়টি তিনি উপজেলা সমন্বয় সভায় উত্থাপন করে প্রতিকারের দাবি করবেন। শামুক কৃষকের অগোচরে ক্ষেত খামারে বন্ধুর ভূমিকা পালন করে থাকে জানান তিনি। জেলা মৎস্য কর্মকর্তা সরকার মুহাম্মদ রফিকুল আলম বলেন, শামুক-ঝিনুক প্রকৃতির খাদ্য শৃঙ্খলার সাথে ওৎপ্রতভাবে জড়িত। কেউ শামুক ঝিনুক ধরে মাছ বা অন্য কোন প্রাণির খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করলে প্রাকৃতিক ভারসাম্য ও বিপর্যয় ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে। যারা শামুক-ঝিনুক ধরে পরিবেশ নষ্ট করছে তাদের বিরুদ্ধে কোন প্রকার ব্যবস্থা গ্রহণ মৎস্য আইনে নেই। এ কারণে আমরা ব্যবস্থা নিতে পারি না।